দ্বীন মোহাম্মাদ সাব্বির,স্টাফ রিপোর্টার:
করোনাভাইরাসের প্রভাবের মধ্যে বন্যায় কারখানায় পানি ঢুকে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন সিরাজগঞ্জের তাঁতমালিক ও শ্রমিকরা।দেশের অন্যতম তাঁত অধ্যুষিত জেলা সিরাজগঞ্জ সিরাজগঞ্জের উৎপাদিত কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হতো। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদকে সামনে রেখে তাঁত পল্লীতে শুরু হয় খটখট শব্দ ও তাঁত পণ্য উৎপাদনের আমেজ।করোনার প্রভাবে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। বন্ধ হয়ে রয়েছে হাজার হাজার তাঁত কারখানা। বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ৮ লাখ শ্রমিক। আর ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা যে লাভের আশা করেছিলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে লোকসানে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন কারখানা মালিকরা।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, সদর, কামারখন্দ, বেলকুচি, রায়গঞ্জ, চৌহালী, কাজিপুরে তাঁত কারখানার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। এই শিল্পের সাথে জড়িত আছেন ৮-৯ লাখ শ্রমিক, মালিক ও কর্মচারী। উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, পাঁচলিয়া বাজারে সাপ্তাহে দু’দিন বিশাল কাপড়ের হাট বসে। এসব হাটে লাখ লাখ টাকার কাপড় বিক্রি হয়।দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসেন এখানে। এমনকি সিরাজগঞ্জের উৎপাদিত কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় তাঁত পরিবারের সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৭০ এবং তাঁত সংখ্য প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতি বছর এ জেলায় হস্তচালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদন হয়ে থাকে। এছাড়া এ শিল্পের সাথে তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জেলার কয়েকটি হাটে তাঁতিদের উৎপাদিত বস্ত্র বিক্রি হয়ে থাকে। যার মধ্যে সোহাগপুর হাট, এনায়েতপুর হাট, শাহজাদপুর হাট ও বেলকুচির হাট উল্লেখযোগ্য।
এবার পবিত্র ঈদ-উল-আযহা কে সামনে রেখে কর্মব্যাস্ততা ছিলনা সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীগুলোতে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদকে সামনে রেখে দিন রাত খটখট শব্দে মুখোরিত থাকত সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীগুলো করোনাভাইরাসের কারণে লোকসানে নুয়ে পড়ছে সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প। ঐতিহ্যবাহী এই তাঁতপল্লীগুলোতে এখন শুধুই সুনসান নীরবতা। গত পহেলা বৈশাখ এবং দুই ঈদে ব্যবসায়ীদের লোকসান গুণতে হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তাঁত কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৮ লাখ নারী-পুরুষ। কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ায় এখন অর্ধাহারে আনাহারে দিন কাটছে তাদের।
ব্যবসায়ীরা বলেন, পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে ঈদুল আজহা পর্যন্ত তাঁতের ব্যবসা হয় জমজমাট। ঈদের আগে কাপড় উৎপাদন করে সারা বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেন তারা। কিন্তু এবার কারখানা বন্ধ থাকায় লাভ তো দূরের কথা শ্রমিকদের বেতনই দিতে পারছেন না। কিন্তু প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের কারণে বাংলা নববর্ষ ও ঈদে কোনো ব্যবসা হয়নি। এ কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। করোনাভাইরাস তাঁতিদের স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে। ঋণ কিভাবে শোধ করবো তা নিয়ে চিন্তাই তারা। শুধু ব্যবসায়ীরা না এর সাথে শ্রমিক-কর্মচারীরাও পড়ছেন বিপাকে।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সিরাজগঞ্জ বেসিক সেন্টারের সমন্বয় কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সিরাজগঞ্জ, বেলকুচি, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর বেসিক সেন্টারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত তাঁতমালিক ও শ্রমিক পরিবারের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বন্যার পানি কমে গেলে এই তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।সরকারি সহযোগিতা ছাড়া তাতিঁদের ঘুরে দাঁড়ানো ‘কঠিন হবে’ বলে অনেকে জানিয়েছেন।
বেলকুচি উপজেলার খিন্দ্র মাটিয়া গ্রামের তাঁতমালিক আকছেদ আলী বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে কয়েক মাস কারখানা বন্ধ ছিল। যখন কারখানাগুলো খোলা হয় তখনই দেখা দেয় বন্যা। বর্তমানে বন্যার পানিতে ডুবে আছে সাজানো সংসার, বসতভিটা আর জীবনের পুরো সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তোলা স্বপ্নের তাঁত কারখানাগুলো ও তাঁতের সরঞ্জাম। পানি কমতে শুরু করলেও এখনও তলিয়ে আছে অধিকাংশ কারখানা। এ অবস্থায় সরকারি সহযোগিতা ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে। ওই এলাকার শফিকুল ইসলাম ও সাইফুকল ইসলামসহ অনেকেই একই কথা বলেন।
সদর উপজেলার গাছাবাড়ি গ্রামের তাঁতশ্রমিক মোকলেস আলী বলেন, “একদিকে করোনাভাইরাস অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় বন্ধ হয়ে গেছে আয়রোজগার। চোখে এখন শুধুই ঘোর অন্ধকার দেখছি। এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি আগে কখনও হতে হয়নি। অনেকের ভাগ্যে এখনও জোটেনি কোনো সহযোগিতা।”
চরসয়দাবাদ গ্রামের জিন্নাহ শেখ ও বাঐতারা গ্রামের সরোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তারাও একই চিন্তার কথা জানান।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ফারুক আহম্মদ বলেন, “জেলার ব্র্যান্ডিং তাঁতকুঞ্জ হিসেবে। এ জেলার মানুষের বড় একটি অংশ জীবিকা নির্বাহ করে এই শিল্পের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত তাঁতমালিক ও শ্রমিকরা যাতে ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সেই লক্ষ্যে বিশেষ বরাদ্দের জন্য স্থানীয় সরকার ও বাণ্যিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।”
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সূর্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট তাঁতশিল্পের সাথে জড়িতদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ প্রত্যাশা করেন ।