জিয়াউদ্দিন লিটন:
বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা” “চাঁদা” শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। সাধারণত যখন কোনরকম পরিশ্রম ছাড়া কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে কারো অনিচ্ছা সত্বেও কেউ নগদ অর্থ আদায় করে সাধারণত সেই টাকা বা অর্থকেই আমরা চাঁদা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে থাকি। সেটি অতীতেও ছিলো এখনো আছে হয়তো ভবিষ্যতেও থাকতে পারে। এই ধরনের চাঁদা যারা আদায় করে তারাই চাঁদাবাজ। আধুনিক এই যুগে এসে এই চাঁদা এলাকার অনেকেই এর চর্চা করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
এটি শুধুমাত্র বিভিন্ন দলীয় ছত্রছায়ায় থেকে কতিপয় সোনার ছেলেরা করছে তা নয়। বিভিন্ন অফিস আদালতে গেলে দেখা যায় বিশেষত সাবরেজিস্ট্রি অফিসে মসজিদের নামে, গ্রাম্য এলাকায় ছেলে বা মেয়ের বিয়ের সময় গ্রামের মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থানের নামে বাধ্যতামুলক ভাবেই বিভিন্ন অংকের চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। মহাসড়কে নামলে দেখা যায় অমুক মালিক সমিতি, অমুক, শ্রমিক ইউনিয়ন, অমুক পৌরসভা ইত্যাদির নামে চলছে চাঁদাবাজি। এই টাকাগুলো কোথায় যায় সেটি আমার আলোচ্য বিষয় নয়।
ওদের পেট আছে বারীতে বৌ-বাচ্চা আছে, আত্মীয়স্বজন আছে নিজেস্ব স্টান্ডার্ড আছে সেগুলোতো এই টাকা দিয়েই করতে হবে নাকি? এছাড়া আর উৎস কোথায়! যাহোক, বলছিলাম “বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা!” এই প্রসংগে। বেশিরভাগ সময়ে প্রবাদটি পুলিশকে হেয়প্রতিপন্ন করার কাজেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে, আমরা করেও থাকি। কিন্তু কেন? পুলিশকি এতই ভয়ঙ্কর যে বাঘকেও হার মানিয়ে দিয়েছে!! দু একটি ক্ষেত্রে পুলিশের সাথে ভুলবোঝাবুঝির কারনে বা দুই একজন অসৎ প্রকৃতির সদস্যের কারনে প্রবাদটি উদাহরণ সৃষ্টি করছে না তা বলছি না। আমি সেটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বলবো আপনি নাও মানতে পারেন সেটি আপনার মানুষিকতা।
তবে এ প্রতিবেদনটি ভিন্ন ধরণের। এটি লেখার পুর্বে আমার দুই একজন বন্ধুর কাছে তথ্য সংগ্রহ করতে যেয়ে বুঝতে পেরেছি তারা আমাকে পুলিশের দালাল উপাধী দিতে প্রস্তুত শুধু আমার গ্রহন করার অপেক্ষায়। তা দিক তাতে আমার কিছু আসে যায় না। একজন শিক্ষক, একজন সাংবাদিক সর্বোপরি সমাজের একজন স্বচেতন নাগরিক হিসেবে সত্যকে সত্য বলার অধিকার যেমন আছে তেমনি কর্তব্যও বলে আমি মনে করি।
এবার আসি চাঁদাবাজি প্রসংগে। চাঁদাবাজি যে হরেক কিসিমের হয় তা মাত্র কয়দিন আগে শিখলাম।আমার জমি দখল করতে হবে বড় ভাইকে টাকা দিয়ে ভাড়া করলাম। অমুক আমাকে দেখে নেবার হুমকি দিয়েছে অমুক সর্দারকে টাকা দিয়ে আমাকে দেখে নেবার আগেই সর্দারকে দিয়ে তাকেই আমি দেখে নিলাম। ইত্যাদি ইত্যাদি……।এসবই পুরোনো গল্প। এসব স্টাইল থেকে ঐ চক্র বেড়িয়ে এসে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সেই সব সন্ত্রাসীরা। চাঁদার টাকা নগদে নিলে চোখে লাগে।
তাই বগুড়ার মাস্তান সিন্ডিকেট বের করল চাঁদাবাজির ‘আধুনিক সংস্করণ’। তারা এখন পরিশ্রম করে টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ী হয়েছে শুধু চাঁদা নামটি আর নেই। তাদের সেই পদ্ধতির নতুন গল্প হলো আপনি বাড়ী করবেন? আমার নিকট থেকেই ইট নিতে হবে। এক নম্বর ইটের দাম নেব নিম্নমানের ইট সরবরাহ করবো। আমার নিকট থেকেই সিমেন্ট নিতে হবে। আমিই সরবরাহ করবো শুধু সিমেন্টের ব্যাগটা একটু লুজ হবে। আমার নিকট থেকেই বালু নিতে হবে। আমি মাপে দু/এক ফিট কম দেবো এবং নিম্নমানের বালু দেব। এমনকি আমি আপনার বাড়ী করার জন্য কাঠের সাটার, বাশের মাচাং, মিস্ত্রি হেলপার সবই সরবরাহ করবো এদের দিয়েই কাজ করাতে হবে।
আমাদের এ সুজোগ না দিলে বুঝতেই পারছেন চাঁদা নামক শব্দটির ফাঁদে আপনাকে পড়তে হবে এবং হয়। তারা সরাসরি নগদ টাকা চায় না। জবরদস্তি করে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী গছিয়ে দিয়ে দেড় থেকে দুই গুণ দাম হাতিয়ে নেয়।এমনকি নিজের পছন্দমত নির্মান সামগ্রী বাহির থেকে নিজে কিনলেও তাদেরকে খুশি করতে হয় টাকা দিয়ে। বগুড়া শহরের প্রতিটি এলাকার মাস্তানির ছবি একই।
তাদের ভাষায় পুলিশের কাছে যাবেন ? আগে ওনাদের যাওয়া আসার খরচ দিন তারপর ওইসব সন্ত্রাসীদের সাথে সমঝোতা করে আপনি আপনার স্থাপনার কাজ করুন। তাহলেতো প্রমান হয়েই গেলো “বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা!” তবে বগুড়া পুলিশ গুনে গুনে ‘ছত্রিশ ঘা’ ঠিকই দিচ্ছে, তবে মাস্তানদের গুণ্ডামি ঠেকাতে। তাঁরাও তাদের এই বদনাম থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য অবলম্বন করেছে ভিন্ন কৌশল। হটাৎ করেই কৌশলী চাঁদাবাজদের ‘পাকা ধানে মই দিল’ বগুড়া জেলা পুলিশ।
বালুর কর্তৃত্ব নিয়েই এক মাসে চারটি খুন হবার পরই মূলত চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বগুড়া জেলা পুলিশ। প্রতিটি নির্মাণাধীন বাড়িতে এখন পুলিশের সার্বক্ষনিক নজরদারী। বাড়ির মালিকেরা যাতে নিজের পছন্দমতো নির্মাণসামগ্রী কিনতে পারে সেব্যাপারে সহায়তা দিতে এরই মধ্যে ৫১৮টি বাড়িতে পোস্টারিংও করেছেন পুলিশ সদস্যরা। বগুড়া পুলিশের এমন পদক্ষেপ স্বাগত জানিয়েছেন সর্বশ্রেনীর মানুষ।
বগুড়া জেলা পুলিশের সিন্ডিকেট তালিকায় উঠে এসেছে বগুড়া সদরের ১৩৩ দুর্বৃত্তের নাম। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুলিশের তৈরি করা ১৩৩ জন চাঁদাবাজ দুর্বৃত্তের সবাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ।এরা বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় নিজ নিজ বাহিনীর ছেলেদের দিয়ে নির্মাণাধীন স্থাপনায় ইট, বালু, সিমেন্টসহ অন্যান্য মালপত্র সরবরাহের নামে চাঁদাবাজি করে। ভয় দেখিয়ে নির্ধারিত দামের দেড় থেকে দুই গুণ বেশি দামে মালপত্র কিনতে বাধ্য করত তারা। এরই মধ্যে বিভিন্ন পুরনো মামলায় সিন্ডিকেটের ১৩/১৪ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ।’ এখন বগুড়ার নির্মাণাধীন প্রতিটি বাড়ির সামনে গেলে দেখা যায় পুলিশের টানানো সতর্কবার্তার ‘বিশেষ বিজ্ঞপ্তি’।
তাতে বড় করে লেখা ‘এ বাড়ির নির্মাণকাজ জেলা পুলিশ বগুড়া পর্যবেক্ষণ করছে’। এর নিচেই লেখা ‘বাড়িওয়ালা নিজ পছন্দমতো সুবিধাজনক জায়গা থেকে ইট, বালু, রডসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী ক্রয় করবেন। কেউ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার নির্মাণসামগ্রী ক্রয় ও বিক্রয়ের চেষ্টা করলে অথবা চাঁদা দাবি করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চাঁদাবাজিসংক্রান্ত কোনো অভিযোগ থাকলে নিম্নলিখিত নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। সেখানে জেলা পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট থানা/ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জের যোগাযোগের নম্বর সংযুক্ত করা হয়েছে।’পুলিশের এমন কর্মকান্ডে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে এলাকার সাধারন মানুষ । পালিয়ে বেড়াচ্ছে অপরাধিরা।