জিয়াউদ্দিন লিটন: স্টাফ রিপোর্টার : উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে বগুড়ার শেরপুর সহ বরেন্দ্রাঞ্চলে মাটির ঘরের ব্যাপক প্রচলন ছিলো। বগুড়ার পশ্চিমাঞ্চল যেমন নন্দীগ্রাম, কাহালু, বগুড়া সদর, আদমদিঘী, দুপচাচিয়া, শীবগঞ্জে মাটির ঘর ছিলো গর্ব করার মতো।
এছাড়া নওগাঁ জেলাতেও বেশ দর্শনীয় দ্বোতালা বা তিনতলা মাটির ঘর এখনো কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির ঘরকে বলা হতো গরীবের এসি ঘর। গরিবের এ.সি উপাধিপ্রাপ্ত এই মাটির ঘর বগুড়ার ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। অনেক সৌখিন মানুষ ঘরের ভিতরে কারুকার্য অংকন করে থাকে ও দেয়ালে রং ব্যবহার করে থাকেন দেখে বুঝার উপায় থাকেনা যে এটি মাটির তৈরী ঘর। অনেক মাটির বাড়ির বয়স প্রায় শত বছর পেড়িয়ে গেলেও এখনো শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কেউবা ইটের ঘরের সঙ্গে মাটির ঘর রেখেছেন বাবার শেষ স্মৃতি হিসাবে। বর্তমানে যেভাবে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে মাটির তৈরী ঘর এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে প্রায় চিরতরে হারিয়ে যাবে শেরপুরের চিরচেনা মাটির ঘর।
বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার পশিমাঞ্চল বিশেষকরে কুসুম্বী, মির্জাপুর,ভবানীপুর ও বিশালপুর ইউনিয়নে কিছু অংশে ব্যাপক হারে মাটির তৈরি ঘর ছিল যা এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল যে, মাটির ঘরে যদি ছনের বা খরের ছাউনি ব্যবহার করা হয় তবে আরাম বহুগুণ বেড়ে যায়। গরমের সময় ঠান্ডা এবং ঠান্ডার সময় নাতিশীতোষ্ণ থাকায় মাটির ঘর বসবাসের জন্য অত্যন্ত আরামদায়ক। অনেকের ভাষ্যমতে, মাটির ঘর মজবুত এবং শীত ও গরমের প্রকোপ থেকে রক্ষাকারী। শুধু মানুষের বসত বাড়ী নয়, বগুড়ার বা শেরপুরের দু-একটি সরকারী স্থাপনাও মাটির তৈরী ছিলো।
শীত এবং গরম সব ঋতুর জন্যই আরামদায়ক হওয়ায় গ্রামের দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানরাও তৈরি করতেন মাটির ঘর । বিত্তবানদের কিছু মাটির দোতলা ঘর এখনো শেরপুর উপজেলার দু-একটি গ্রামে নজরে পড়ে।বিশেষ করে মির্জাপুর ইউনিয়নের ভাদড়া,বিশালপুর এবং ভবানিপুর ইউনিয়নের রানিরহাট এলাকায় বা এঁটেল ও ছোট পাথরযুক্ত লাল মাটির এলাকায় দূ’তলা মাটির ঘর এখনো দেখা যায়। এসব এলাকায় গ্রামের ধনী-গরিব নির্বিশেষে বেশিরভাগ মানুষের ঘরই ছিল মাটির তৈরী। তবে ইদানিং বহু লোক প্রবাসে থাকার ফলে নতুন করে এসব এলাকায় মাটির ঘর তৈরির ঝোঁক কমেছে।মাটির ঘরের ব্যয়বহুলতা পর্যবেক্ষণ করে স্থানীয় বাসিন্দারা মাটির ঘরের পরিবর্তে দালান-কোঠা বানাচ্ছে। তবে অনেক পরিবার এখনো মাটির ঘরে বসবাস করেন।
মূলতঃ এঁটেল মাটি দিয়ে মাটির ঘর তৈরি করা হয়। দুই আড়াই ফিট চওড়া দেয়াল এবং উঁচু দেয়ালের উপর শন/খড়/ টিন দিয়ে চৌচালা বা দোচালা, একতলা-দেড় তলা ও দোতলা ঘর তৈরি করা হয়। মির্জাপুর ইউনিয়নের ভাদড়া গ্রামের এক বৃদ্ধ বলেন, এক সময় গ্রামের বিত্তবানদেরও মাটির ঘরের দিকে ঝোঁক ছিল কিন্তু মাটির ঘরের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। অবস্থাসম্পন্নরা এখন মাটির ঘর ভেঙে ইট-সিমেন্টের দালান কোঠা তৈরি করছে। বিশালপুর গ্রামের আবু রায়হান নামের এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা হলো, জানতে চাইলাম মাটির ঘর বিলুপ্তির কারণ, তিনি বলেন গ্রামের মানুষ এখন লেখাপড়া শিখছে, শহরের পরিবেশে শহরের মানুষের সাথে মিশে তাদের সভ্যতায় নিজেদের দাঁড় করাতে চায়।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। এলাকার প্রায় সকল গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। জেলা সদর এবং উপজেলা নিকটে হওয়াতে এবং সদরের সাথে যোগাযোগের সুব্যবস্থা, বিভিন্ন এন জি ও কতৃক ঘর তৈরীর জন্য ঋণ প্রদানের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির গতি সচল হওয়ায় মাটির ঘরের পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে পাকা ঘর। তাছাড়াও ইদুঁরের উপদ্রব একটি মূখ্য কারণ । ৪/৫ বছর পর পর মাটির ঘর সংস্কারের ঝামেলা ও ব্যয়বহুল দিক পর্যবেক্ষণ করে মাটির ঘরের পরিবর্তে দালান-কোঠা বানাতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এই অঞ্চলের মানুষ। তাছাড়া বর্তমানে একটি মাটি ঘর ভালভাবে বানাতে গেলে সমপর্যায়ের পাকা ঘরের দেড়গুণ পয়সা খরচ হয় জায়গাও লাগে বেশি। তাই এখন মাটির ঘর তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে এখনো গ্রামে অনেকেই বসবাসের জন্য মাটির ঘরই পছন্দ করেন।
বসবাসকারী ব্যক্তিরা বলেন পূর্বপুরুষের রেওয়াজ অনুযায়ী ভাঙ্গেনি মাটির ঘর। ভাঙতে চায় না কেউ কেউ। উপরের তলায় উঠতে কাঠের বা বাঁশের তৈরি সিঁড়ি অনেকেই ব্যবহার করেন। আবার মাটির সিঁড়িও কেউ কেউ তৈরি করে দ্বিতল ভবনে। একটি ঘর তুলতে সময় গুনতে হয় কমপক্ষে তিন চার মাস। খরচও কম নয়। মাটির ঘর ভালোভাবে নির্মাণশৈলীতে খরচ বাবদ গুনতে হয় প্রায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। একটি ঘর নির্মাণ করার যথেষ্ট কষ্টের কাজ।
একসময় মাটির ঘরের কথা ইতিহাস হয়ে থাকবে। স্মৃতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। বাংলাদেশ লোক কারুশিল্প কারুপল্লীতে হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক বাহক মাটির ঘর এখনো টিকে আছে। তবে সাধারণভাবে গ্রামবাংলা থেকে মাটির ঘর প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।