” রাজা নেই রাজত্ব নেই ” তবুও টিকে আছে শত বছরের পুরানো মাটির রাজবাড়ি
- আপডেট সময় : ০৭:১১:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪ ৫৯ বার পড়া হয়েছে
নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মাঝে দৃষ্টিনন্দন একটি মাটির রাজবাড়ি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজা নেই রাজত্ব নেই ” তবুও টিকে আছে শত বছরের পুরানো এই মাটির রাজবাড়ি।
চুনসুরকির বাহারি কারুকাজ আর আলোর ঝলকানিতে দোতলা এই রাজবাড়িটি এখন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে ” “জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের” বাবা এই গ্রামে এসে পালদের কাছ থেকে একটি মাটির দোতলা বাড়ি কিনে নেন। এবং সেখানে তার জমিদারি স্থাপন করেন এবং তিনি পরবর্তীকালে ” জমিদার সারদা প্রসাদ রায় ” এখান থেকেই এই জমিদারি প্রথা চালু করেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত পর্যন্ত বিলুপ্ত না হয়েছে জমিদারি চালিয়ে গিয়েছেন। এই রায় বাড়ির জমিদারি আত্রাই তথা বাংলাদেশের দিনাজপুর, নাটোর এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
যার সব কাজই পরিচালিত হতো এই মাটির বাড়ি থেকে। কথিত ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, জমিদার সারদা প্রসাদ রায়ের দুই ছেলে ছিলেন। বড় ছেলের নাম বড়দা প্রসাদ রায় এবং ছোট ছেলের নাম শরৎ রায়। বড়দা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হতো বড় তরফ আর সারদা প্রসাদ রায়ের পরিবারকে বলা হত ছোট তরফ। এই বড়দা প্রসাদ রায় তৎকালীন ১৯৪২ সাল থেকে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই এলাকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেটা এখানকার আঞ্চলিক ভাষায় বলা হত চেয়ারম্যান। ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে এখানকার জানান, বলিহারের রাজা বিমলেন্দু রায় বাহাদুরের মাতুলালয় ছিল এই রায় বাড়ি। এই রায় পরিবার তৎকালীন সময়ে শিক্ষা সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক তৎপর ছিল।
তৎকালীন দুর্গাপূজার সময় এই পরিবারেরই সদস্য মুকুল রায় ও বন্দর রায়সহ প্রমুখ ব্যক্তিরা ইন্ডিয়া থেকে শিল্পী নিয়ে এসে তাদের সঙ্গে থেকে থিয়েটার পরিচালনা করতেন। যাত্রাপালা করতেন, এখানে বসবাসরত বিভিন্ন উচ্চ বংশীয় এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে পূজার সময় সংস্কৃতি যুদ্ধ হতো এবং সে যুদ্ধে এরাই জয়ী হতেন। এই পরিবারের জমি জমা মোটামুটি ৩০০ বিঘার মতো ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এক সময় নাকি বড়দা বাবুর আমলে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা।
যা ইতিহাসের ১৯৬৪ সালের ৬ জানুয়ারির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ হিসেবে ধরা হয় এই পরিবারের লোকজনের আত্ম-অহংকার এবং দাম্ভিকতা। তারা তৎকালীন সময়ে মুসলিম পরিবারের সদস্যদের জুতো পড়ে হাঁটতে দিতেন না, ভালো বাজার করতে দিতেন না, চেয়ারে বসতে দিতেন না। লোক মুখে শোনা যায়, সেই সময়ে চেয়ার নিয়ে কথা বলার সময় এক মুসলিম ব্যক্তির ওপর মন্মথ রায়ের থুতু লেগে যায়, আর এতে করে মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
এরপর মোজাহার ডাকাত ও ইরফান ডাকাতের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেই দাঙ্গায় এই পরিবারের ১৩ জন সদস্য নিহত হয়। মৈনমের ১৯৬৪ সালের রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস একুশে পরিষদ নওগাঁ লিপিবদ্ধ করেছে। সেসময় জমিদার বড়দা প্রসাদ রায়ের স্ত্রীকে কেটে কুচি কুচি করা হয়।
এই ঘটনায় বড়দা বাবু কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান। তিনি যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। এবং ১৯৭১ সালের “মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ” বিজয়ের পরে। এই রায় পরিবারের সদস্যরা এক এক করে বিভিন্ন জায়গায় চলে যান। সর্বশেষ এখানে ছিলেন বুরন রায় এবং বাবন রায়।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে ক্রয় সূত্রে এ জমির মালিক এস এম ব্রুহানী সুলতান গামা। গামার বড় ছেলে এস এম আশকার ইবনে সুলতান শান্ত গামা জানান, আমার দাদু এই মাটির বাড়িটি কিনেছিলেন। এরপর নিজের চেষ্টায় বাড়িটির আসল কারুকাজ অক্ষত রেখে নতুন করে রঙের কারু কাজ করানো হয়েছে। এবং কিছু স্থানে সংস্কার করা হয়েছে। যেহেতু বাড়িটি অনেক পুরাতন এবং এর একটা ইতিহাস রয়েছে তাই চেষ্টা করেছি বাড়িটি মেরামত করে পুরোনো ঐতিহ্য এবং জৌলুস ধরে রাখার।
তাছাড়া সবার জন্য এই বাড়িটি দেখার জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন বাড়িটি দেখতে। এটাই আমাদের ভালো লাগার গর্বের বিষয়।
এই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মৈনমে। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। তার মধ্যে এই রায় বাড়ির ইতিহাস অন্যতম।