বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক হত্যা,নির্যাতনের বিচার ও হত্যা-নির্যাতন বন্ধের প্রতিবাদে বিশ্ব গণমাধ্যম এক হও
- আপডেট সময় : ০৯:৩০:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০২৪ ৪২ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি ঝুঁকিপূর্ণ উত্তপ্ত ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে।এদেশে সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়,আপদ,বিপদ ও বালামছিবতেও পরিপূর্ণ।
জাতিসংঘের তথ্যেমতে,বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক পেশাগুলোর মধ্যে সাংবাদিকতা একটি কীঘটছে, কেনঘটছে, কোথায় ঘটছে,কিভাবে ঘটছে ,তা অনুসন্ধান এবং প্রতিবেদন তৈরি করতে সাংবাদিকেরা বিভিন্ন স্থানে যান।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত,এই পেশা আবার কখনো কখনো নিজেই অপহরণ,হামলা,মামলা,এমনকি হত্যার মত গল্পও হয়ে ওঠে।
১৯৯২সাল থেকে সাংবাদিক হত্যা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা বাংলাদেশে একটি গুরুতর বিষয় হয়ে উঠেছে।পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে ২০০৪ সাল থেকে।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা নিউইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে,সাংবাদিকদের জন্য একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণদেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয়।
সিপিজের তথ্যমতে,১৯৯২-২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৩৪ জন সাংবাদিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে।চলতি বছরের গেল ১৫ জুন জামালপুরে পরিকল্পিতভাবে বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোরের স্থানীয় সংবাদদাতাকে হত্যা করা হয়।এনিয়ে সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫-এ।নিহত ৩৫ সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের হাহাকার আজ দেশবাসীর কানে কড়া নাড়ছে।একটি মহৎ পেশার নাম সাংবাদিকতা যেখানে অর্থের মোহ শুধু একটি স্বপ্ন মাত্র।নিহত সাংবাদিকদের হয়তো অর্থের মোহছিলনা।কিংবা তারা খুনিদের সাথে কোন প্রকার আপসে নাযাওয়ার জন্য যথেষ্ট নির্ভীক ছিলেন,আর যেকারণে তাদের এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়েছিল।
সাংবাদিক মোহাম্মদকে হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার মিশন শুরু হয়েছিল।কামরুজ্জামান ছিলেন নীলফামারী-ভিত্তিক সাংবাদিক। তিনি ‘নীলসাগর’ নামে একটি স্থানীয় পত্রিকার রিপোর্টার ছিলেন।১৯৯৬ সালের ১৯ফেব্রুয়ারি তাকে হত্যা করা হয়।এরপর ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে প্রবীণ সাংবাদিক মানিক চন্দ্র সাহা হত্যা যেন বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার একটি অমীমাংসিত উদাহরণ।
মানিক চন্দ্র সাহা ছিলেন দৈনিক‘নিউ এজ’পত্রিকার সংবাদদাতা ও বিবিসি বাংলার কন্ট্রিবিউটর।খুলনা প্রেস ক্লাব থেকে খুলনা শহরেই নিজ বাড়িতে যাওয়ার সময় আততায়ীরা তার রিকশা থামিয়ে হাত বোমা ফেলে হত্যা করে।দীর্ঘ তদন্ত ও দীর্ঘ শুনানির মধ্যদিয়ে বিচার শেষে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ১১ আসামির মধ্যে ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ১ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করে সাংবাদিক সমাজ এর প্রতিবাদ জানায়।এই মামলার বিচারে মৃত্যুদণ্ড ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত ছিল এবং সাংবাদিকরা মামলার পুনঃতদন্তের দাবি জানায়।মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে খুলনায় তার অফিসের সামনে আরেকটি বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু।
আরেক সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজা বাজারে তাদের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল,যা একটি রহস্য এবং বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েগেছে।সম্প্রতি আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ১১১তম বারের মতো পেছানো হয়েছে। আগামী ১৫ অক্টোবর২০২৪ প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছে আদালত।
কিছু কিছু সাংবাদিক হত্যার রহস্য নামমাত্র তদন্ত হলেও অনেক হত্যার ঘটনাই কয়েক দশক ধরে এই দেশে অমীমাংসিতই রয়েগেছে।২০০০-সালে বাংলাদেশের যশোর জেলায় দৈনিক জনকণ্ঠের প্রাক্তন বিশেষ প্রতিনিধি শামসুর রহমান তার অফিসে দুই সশস্ত্রধারী লোকের হাতে নিহত হন।২০২১ সালে নিহত সাংবাদিকের ভাই বকুল গণমাধ্যমকে বলেন যে, খুলনার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধানে থাকাসত্ত্বেও মামলার তদন্ত এখনো শুরুহয়নি।
বাস্তবতা হলো এটাই যে,সাংবাদিক হামলা, মামলা এবং হত্যার সমস্যাস মাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আগ্রহের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।সাংবাদিক হত্যার নিন্দা করার ক্ষেত্রে অবশ্য রাজনীতিবিদরা বেশ কয়েক বার একে অপরের সাথে দোষারোপের খেলায় মেতেছেন, অথচ ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা খুব কমসময়ই হত্যা মামলার সুরাহা করতে পেরেছেন।শুধু তাই নয় এব্যাপারে তেমন কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলেও আমি মনে করি।
বাংলাদেশে শুধু নয়, সাংবাদিকতা এখন বিশ্বব্যাপী একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।২০২২ সালের১১ মে ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের হত্যার শিকার হন, যিনি ২৫ বছর ধরে আল-জাজিরার জন্য কাজ করেছিলেন।এঘটনা বিশ্ব সাংবাদিক সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ডকে শীতল করে দেয়।বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতায় ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতুলে ধরে শিরিনের হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রশ্নটি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে যে,সত্যিই কি বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য‘রেডজোন’হয়ে উঠছে?এ প্রশ্ন দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে আর প্রশ্নের উত্তর আগামী দিনে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজকেই নির্ধারণ করতে হবে।
এছাড়াও ২০২৩-সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন,হয়রানি,মামলা,হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন,মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।সংগঠনটি শুক্রবার (৩১মার্চ-২০২৩) মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
আবার প্যারিস ভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ)একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বিগত ২০ বছরে সারাবিশ্বে প্রায় ১ হাজার ৭০০ সাংবাদিকদে হত্যা করা হয়েছে।সে হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ৮০ জনের বেশি সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন।
(আরএসএফ)ওই প্রতিবেদনে বিশেষ করে সংবাদকর্মীদের জন্য ২০০৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ২ দশককে অভিহিতকরাহয়েছে ‘প্রাণঘাতী’হিসেবে।
এছাড়াও ২০২৩ সালে নিহত ৯৯ সাংবাদিকের মধ্যে ৭৭ জন
ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে মারা গেছেন।এক দশকের মধ্যে মিডিয়ার জন্য গত এক বছর ছিল সবচেয়ে ভয়ানক বছর।কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্ণালিস্টস একথা জানিয়েছে।
সিপিজে বলেছে,সোমালিয়া এবং ফিলিপাইনে প্রাণহানি স্থিতিশীল থাকলেও বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের হত্যার ঘটনা বছরের পর বছর কমে যেত যদি ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ৭৭ সাংবাদিকের মৃত্যু না হতো।
২০১৫ সালের পর থেকে এটা সর্বোচ্চ এবং ২০২২ সালের পরিসংখ্যানে প্রায় ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিপিজে বলেছে ‘ডিসেম্বর ২০২৩ সালের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, একটি দেশে সারা বছরে যত বেশি সাংবাদিক মারা গেছে, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে তার চেয়ে বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছে।সূত্র:’নিউইয়র্ক,১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ (বাসস/এএফপি):
গেল বছর(২০২৩) ৩৬৫ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন,আর খুন হয়েছেন ২ জন।এ ছাড়া ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ জন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস)‘মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০২৩’পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে এইচআরএসএসের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা ৫৮ মামলায় ১৮৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬০ জন।
দেশের ১২টি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং এইচআরএসএসের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিটের তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের এই মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সূত্র:এইচআরএসএসের পর্যবেক্ষণ,প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩।
বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার পালাবদলে যে দল যখন ক্ষমতার মসনদে বসে, তখন আইন আদালতের মাধ্যমে নিজেদের ওপর হওয়া সকল অন্যায় অপরাধের হিসেব ঠিকই বুঝিয়ে নেয়।দু:খ জনক হলেও সত্য যে,সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার কেউ করে না।যদিও দু,একটির হয় এটা উদাহরণ মাত্র।এর মূল কারণ প্রায় সাংবাদিকরা এখন রাজনৈতিক দলের লেজুড় ভিত্তি।নিজ দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন কিছু লিখেনা,বসে বসে সুবিধা ভোগ করে আর অন্য দলের সত্য মিথ্যা লিখতে থাকে,আবার অপজিশন দল ক্ষমতায় এলে তারাও ওই একই কাজ-ই করে, ফলে সাংবাদিক হয়ে যায় উভয়ের শত্রু।এই পক্ষ নিয়ে চলার করনে পালাবদলে দু-চারজন ছাড়া গণমাধ্যমের সবায়কে সকল রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করে।
প্রতিটি পেশায় ঝুঁকি ও ব্যতিক্রম কিছু থাকে,এটা থাকবে।তবে পেশাদারীত্বের ক্ষেত্রে ঐক্যমতের ভিত্তিতে জোটবেধেঁ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ,উপস্থাপন ও প্রকাশনার মাধ্যমে পরিবেশন করলে সে ঝুঁকি অতি নগণ্য বলে আমি মনে করি।
তাই আসুন বিশ্বব্যাপী হত্যা,আহত ও নির্যাতিত সকল সাংবাদিকদের বিচারের দাবি এবং এই হত্যা ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে বিশ্ব গণমাধ্যম সোচ্ছার হই-এক হই।(সময় পেরিয়ে গেছে বহুবার-এবার সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়াবার)।