নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেকারত্বের অবসান হতে পারে
- আপডেট সময় : ০৯:৫৫:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪ ১৩০ বার পড়া হয়েছে
দেশে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা-সরকারি-আধা সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হয়। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেলে বাড়ে বেকারত্ব।
গত বছরের চতুর্থ কোয়ার্টারের সঙ্গে চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারে বেকারত্বের হার বেড়েছে। বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি একই অঙ্কের কাছাকাছি থাকলেও সেই অনুপাতে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু কেন? মূলত দেশে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও ব্যক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যর্থতা, অকৃষি খাতে অধিক প্রাধান্য না দেওয়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দুরবস্থা, দেশে বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে অপ্রতুলতা, বিনিয়োগের বিপরীতে অধিক ঝুঁকির আশঙ্কা, অতিমাত্রায় ব্যাংক সুদ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রায় সকলপ্রকার কাজে অধিক দলীয়করণ, দুর্নীতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জায়গা ও অবকাঠামোগত সমস্যাসহ আর্থিক বিশৃঙ্খলতার কারণে আমাদের দেশে বিনিয়োগ দিন দিন কমতে শুরু করেছে। ফলে ক্রমাগত হারে সঙ্কুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের হার ছিলো ৪ দশমিক ২ শতাংশ। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ৩৩ শতাংশের বেশি পুরোপুরি বেকার। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারদের মধ্যে তারতম্য রয়েছে। শিক্ষিতদের বড় একটি অংশ পছন্দসই কাজ না পাওয়ায় বেকার হয়েছে। তারা ‘ভালো’ কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ‘ভালো’ কাজ না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের রয়েছে। কিন্তু অশিক্ষিত বেকারদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এ কারণে এই শ্রেণিতে বেকারত্ব কম। ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে সম্পাদিত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ বেকার। প্রধানত তিন কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, দেশে বর্তমানে চাকরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদনশীল ও কৃষি খাতে; এই দুটি খাতে আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস তরুণদের কাজের সুযোগ কম এবং কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি। আবার যেসব শিক্ষিত যুবক চাকরির বাজারে রয়েছেন, তারা এসব কাজে নিজেদের যুক্ত করতে চান না। আর তৃতীয়ত, করোনার কারণে ব্যবসা- বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যেসব শিক্ষিত যুবক নিজেরা ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত ছিলেন, ওই সময়ে তারাও বেকার হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বড় অংশই এখন বেকার। পড়াশোনা শেষ করে বছরের পর বছর চাকরির জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি তরুণদের জন্য শ্রমবাজার আরো কঠিন হয়েছে। ‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ’ বা ‘বিশ্ব জুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আইএলও বলেছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশি তরুণদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, যদিও জাতীয় পর্যায়ের বেকারত্বের হার মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় তরুণদের বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সম্প্রতি একশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ। গত এক বছরে কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তার হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যালোচনায় বলা যায়, আগে বেকারত্ব পরিস্থিতি যা ছিল, এখনও তাই আছে। সামগ্রিকভাবে হয়তো বেকারত্বের হার বাড়েনি; কিন্তু বড় সংখ্যায় চাকরির সুযোগ এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়নি। মোট কথা, কর্মসংস্থান চিত্রের পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশে বছরে ১৮ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে যুক্ত হন। এর মধ্যে গড়ে ছয় লাখ বিদেশে পাড়ি জমান। ১০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান হয় দেশের শ্রমবাজারে। এর মধ্যে একটি অংশ পছন্দ ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পান না। বাকিরা বেকার থেকে যান। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া এবং দক্ষতার অভাবই বেকারত্বের বড় কারণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসের তুলনায় চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেড়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। দেশে এখন কর্মহীন লোকের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার জন, যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার। এই হিসাবে বেকার সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার। বেকার কারা- আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যাঁরা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং গত ৩০ দিন ধরে কাজ প্রত্যাশী ছিলেন, তাঁরা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই নিয়মে বেকারের হিসাব দেয়। গত ৬ মে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। প্রতিবেদনে বরা হয়, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) দেশে নতুন করে বেকার হয়েছেন ২ লাখ ৪০ হাজার জন। এই তিন মাসে নারী ও পুরুষ উভয় জনসংখ্যার মধ্যেই বেকারত্ব বেড়েছে। তবে গত বছরের একই প্রান্তিকের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, সার্বিক বেকারত্ব হার একই রয়েছে। কিন্তু পুরুষের বেকারত্ব বেড়েছে এবং নারীদের ক্ষেত্রে তা কমেছে।
আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের বড় একটি জায়গা দখল করে আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক ও বেসরকারি খাত। যদিও এই খাত সব সময় অনিশ্চিত কর্মস্থল, নিম্নমানের আয় ও নানা রকম ঝুঁকিতে পূর্ণ থাকে, তারপরও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে উক্ত খাতটি বিশেষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু বেসরকারি খাতের প্রতি সংশ্লিষ্টদের চরম উদাসীনতা, দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের প্রতি অধিক বৈষম্য, বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে চাহিদানুযায়ী ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, ঋণের বিপরীতে দুই অঙ্কের সুদ, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও জায়গার স্বল্পতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লালফিতার দৌরাত্ম্য, আমদানি-রপ্তানি নীতিতে অধিক বৈষম্য, ঘুষ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং অবকাঠামোগত দুবর্লতাসহ নানাবিদ কারণে প্রতিনিয়ত বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ। এছাড়াও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনের প্রতি অধিক আস্থাহীনতা, ভয়ভীতিসহ দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি নানাবিদ কারণেও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তথা বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে প্রয়োজনীয় শিল্পকারাখানা গড়ে না ওঠার কারণে দেশে চাহিদানুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে। চলতি বছরের ২ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ম্যাক্রো পোভার্টি আউটলুক ফর বাংলাদেশ প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০২২-২৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি নতুন করে চরম দারিদ্র্য সীমায় পড়বে। অর্থাৎ, তাদের দৈনিক আয় হবে দুই ডলার ১৫ সেন্টের চেয়েও কম। আর মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছাবে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশে। এগুলোর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতিও বেকারত্ব বাড়ার উদ্বেগজনক প্রবণতার চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সময় থাকতেই সংশ্লিষ্টদের কার্যকরী পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। সরকারের ঘোষিত রূপকল্প বাস্তবায়নে দেশে অপারসম্ভাবনার বিশাল মানবসম্পদকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের উপযুক্ত কাজে লাগাতে হবে। বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রদানে নানামুখী জটিলতা ও সুদের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রতি এখন এদেশের বিনিয়োগকারীরা অধিক ঝুঁকছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি খাতে দ্রুত গতিতে বাড়ছে বিদেশি ঋণ। এতে ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ বিরাট অঙ্কের টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। যা দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অশুভ বলে মনে করি। অনেক বিনিয়োগকারী দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় তারা বিদেশে বিভিন্ন ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করছে। ফলে দেশে বিনিয়োগের বিপরীতে অধিক পরিমাণ টাকা বিদেশের মাটিতে প্রেরণ করা হচ্ছে। ফলে দেশে অর্থ বিনিয়োগ না করায় দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও জনগণ কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৃষ্টি হলেও তা দেশ ও জাতির কল্যাণে তেমন কাজে আসছে না, যা দুঃখজনক।
বেকারত্ব সমস্যা সমাধান করতে হলে শিক্ষিত বেকারদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের সুদমুক্ত সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এর জন্য দরকার বিনিয়োগ এবং চাকরি তৈরি করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা। বেকারত্ব দূর করার জন্য আশু করণীয় হলো- প্রশিক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টি। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তবে গতানুগতিক নয়, উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এমন প্রশিক্ষণ একজন প্রশিক্ষণার্থীকে উদ্যোক্তায় পরিণত করবে। এর জন্য উপজেলাভিত্তিক ম্যাপিং প্রয়োজন। যে উপজেলায় যেমন রিসোর্সের জোগান রয়েছে, তার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণার্থীকে দক্ষ করে এবং ঋণ সুবিধা দিয়ে তার উদ্যোগ দাঁড় না হওয়া পর্যন্ত সহায়তা করতে হবে। এর মাধ্যমে বড় সংখ্যায় বেকারত্ব কমানো সম্ভব হবে। নিজেদের উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে তরুণ ও শিক্ষিত যুবকেরা যাতে আগ্রহী হয় সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে তাদের জন্য। আর নিজেদের উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রয়োজন হবে ব্যাংক ঋণের। সে জন্য তাদের সহজে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অর্থায়ন ব্যবস্থায় এ উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে আশানুরূপ বিনিয়োগের খুব বেশি সম্ভাবনা নেই। তাই ঋণসুবিধা বাড়িয়ে তরুণদের স্ব-কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। আশা করছি এর সঙ্গে তাল দিয়ে বেকারত্বের হারও কমবে।