নকল পণ্যের ভয়াবহ প্রভাবের কাছে অসহায় নাগরিক জীবনযাত্রা
- আপডেট সময় : ০৯:০৪:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ মার্চ ২০২৪ ২৫৫ বার পড়া হয়েছে
জিয়াউদ্দিন লিটন, লেখক: শিক্ষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট :
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় সবাই খুব খুশি এবং ভালো আছেন। প্রতিদিন স্টোরি দিচ্ছেন, খেতে যাচ্ছেন, বেড়াতে যাচ্ছেন, খাচ্ছেন। ছবিগুলো প্রায় সবই এডিট করা। আসল জগতের আড়ালে একটা ভ্রমের জগৎ গড়ে উঠেছে যেন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে, চাকুরী খুঁজতে গিয়ে, কত মানুষ ঠকছে, মিথ্যা ফাঁদে পা দিচ্ছে। এই মিথ্যার জগৎটা বাস্তবে আমাদের আরও একা করে দিচ্ছে। জীবন থেকে আমাদেরকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছি নকলে আর মেকিতে।
দেশের নাগরিক জীবনযাত্রায় নকলের প্রভাব সর্বত্র। একসময় শুধুমাত্র পরীক্ষার ক্ষেত্রেই টুকিটাকি নকলের কথা জানা ছিল মানুষের। এখন সবকিছুই যেন নকল বাজিতে বন্ধ হয়ে পড়েছে। নকল জন্ম সনদ থেকে শুরু করে নকল মৃত্যু সনদ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই নকলের একচ্ছত্র দাপট। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যেন আসলের সন্ধান পাওয়া ভার। “নকল হতে সাবধান” এমন সতর্কীবার্তা দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। নকল ফোন নকল স্বাক্ষর, নকল দলিল, শোনা যায় নকল চাল, নকল ডিম পর্যন্ত মার্কেট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরপর আবার নকলের নতুন ভার্সন “নকল পাত্র-পাত্রী”। অবাক হবার কিছু নেই সঙ্ঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্যরা ম্যাস মিডিয়া ও বিভিন্ন ঘটক ভাইয়ের নামে প্রতিষ্ঠান খুলে এ নকল নকল পাত্র পাত্রীর জমজমাট বাণিজ্যের ফাঁদ পেতে বসেছে। লন্ডন আমেরিকায় বসবাসকারী বিধবা বিপত্নী পাত্র-পাত্রী জন্য বিধবা বিপত্নীক পাত্র বা পাত্রী চাই। বিবাহ পরবর্তী তাদেরকে লন্ডন আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হবে। এমন লোভনীয় প্রস্তাব কে হারাতে চায় বলুন। ডোরাকাটা দাগ দেখে যেমন বাঘ চেনা যায় কিন্তু নকল মানুষ চেনার কোন উপায় না থাকায় নকল পাত্র পাত্রীর প্রতারণা থেকে রেহাই পাচ্ছে না অনেকেই। আবার দিব্যি নকল বউ নিয়ে দিনের পর দিন মাসের পর মাস ঘর সংসার করে করে যাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ।
নকল নিউজের কথা নাইবা বললাম (কপি পেস্ট)। কয়েক বছর আগে ফেসবুকে নকল পত্রিকারও অবতারণা হয়েছিলো। মাস্টহেড অবিকল রেখে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি খবরকে নানা আঙ্গিকে উপস্থাপন করে বানানো হয় নকল পত্রিকাগুলো। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়াকে কেন্দ্র করেই এমন ভয়ঙ্কর প্রতারণার শিকার হয়েছিল প্রথম শ্রেণীর বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক। এছাড়াও ফেসবুকে নকল বা ফেক আইডি চোখে পড়ে অহরহ। এমনকি নকল লাইক এর বন্যা বয়ে যায়। গবেষকরা বলছেন কলিউশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিনামূল্যে কোটি কোটি নকল লাইক পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত হতে আপনার একাউন্টের প্রায় সব এক্সেস গ্র্যান্ট করে নিজেও প্রতারণার কব্জায় আটকে পড়েছেন অনেকেই।
শুধু কি তাই? রাজনীতিতেও আসল এবং নকল দলের প্রভাব রয়েছে। আসল বিএনপি-নকল-বিএনপি, আসল জাতীয় পার্টি-নকল জাতীয় পার্টি। ২০১৭ সালের বিএনপি অফিসের দখল নিয়ে বিএনপি এবং আসল বিএনপিদের ভিতরে ধাওয়া পালটা ধাওয়া, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ চলছিলো। সে সময় একটি পিক আপে করে আসল বিএনপি’র কিছু কর্মী সেখান দিয়ে যাওয়ার পথে বিএনপির কর্মীরা সেই পিকআপে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে বেশ কিছু বিএনপি কর্মী আহত হবার ঘটনাও নগরবাসী প্রত্যক্ষ করেছিলো। এবার আসুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে। পত্রিকা খুললে প্রায়ই দেখা যায় নকল পুলিশ, ভূয়া ডিবি, ভূয়া র্যাব, ভূয়া ম্যাজিস্ট্রেট ধরা পড়েছে। গ্রেফতারের নামে নিরীহ মানুষদেরকে তুলে নিয়ে যেয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এদের দাপটে বিপর্যস্ত অনেকেই। মোটকথা নকলের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছে গোটা দেশ। ইলেকট্রনিক্স এর দোকানে যাবেন? একই ব্রান্ডের পণ্য দুই রকম তিন রকম দামে পাওয়া যায়। যেমন ধরুন দেশের বাজারে আসল উইন্ডোজ সিডির দাম যদি আমরা জানতে চাই তাহলে দেখা যায়, আসল উইন্ডোজ ৭ এর দাম ১২৫০০ টাকা, উইন্ডোজ ১০ এর দাম ১৪৫০০ টাকা। কোন কোন দোকানে উইন্ডোজ ১০ এর প্রফেশনাল ভার্সনটি পাওয়া যায় ১৩৫০০ টাকায় কিন্তু পাইরেটেড উইন্ডোজ সিডি ৬০-৭০ টাকায় অহরহ। একটি দোকানে আসল উইন্ডোজ বছরে ৫/৬ টি বিক্রি হলেও উইন্ডোজের ক্র্যাক ভার্সন বা ট্রায়াল ভার্সনের সিডি প্রতিদিন ২-৩ শতাধিক বিক্রি হয় বলে জানালেন একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ী।
এমন কিছু নেই যা নকল হচ্ছে না। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে সার, কসমেটিক্স, পানীয়, ইলেকট্রনিক্স, মোবাইল পার্টস, প্লাস্টিক পণ্য, সিমেন্ট, মোটর পার্টস, বিমানের যন্ত্রাংশ, ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া পুলিশ, ভুয়া ন্যাশনাল আইডি কার্ড-কি নেই নকল? অহরহ চোখের সামনে এসব ভুয়া এবং নকল জিনিসপত্র বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পণ্য আসল না নকল তা ভেরিফিকেশনের জন্য হলোগ্রাম, স্টিকার, স্ক্যানার, আরএফআইডি ট্যাগ বারকোড ইত্যাদি সিস্টেম চালু আছে কিন্তু সেসব হলোগ্রাম বা স্টিকার গুলো যখন নকল করা হয় তখন গ্রাহক কোনভাবেই আসল নকল আলাদা করতে পারে না। নকল টিভিও আসল হয়ে যায় স্টিকার আর সফটওয়্যার এর গুণে। নকল টিভিতে দামি ব্রান্ডের মনোগ্রামযুক্ত স্টিকার, লোগো বসিয়ে দিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে সফটওয়্যার দিয়ে দিলেই আসল হয়ে যায়। ফলে টিভি সেট চালু করলেই অবিকল স্যামসাং এলজি কিংবা সনি লেখা ভেসে উঠে টিভির পর্দায়। ক্রেতা কম দামে দামি ব্র্যান্ডের টিভি কিনে এভাবেই নকলকে আসল ভেবে নিয়ে যেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিনের পর দিন। নকল মোবাইল সেট কিনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নাজেহাল হবার খবর পাওয়া যায়। যে সিসি ক্যামেরা দিয়ে দুর্নীতি দমন করবেন, চোর ধরবেন সেই সিসি ক্যামেরাও নকল। নকল সিসি ক্যামেরা দিয়ে বাজারে সয়লাব। নকল ও নিম্নমানের প্রসাধনী সামগ্রী যেমন, সাবান, চন্দন, মেছতা দাগ নাশক বিভিন্ন ক্রিম, তেল, পারফিউম নানা ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী চকচকে মোড়কে বিভিন্ন দেশের লেভেল লাগিয়ে আসল রূপে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। পৃথিবীতে যত রকমের নামকরা ব্রান্ডের প্রসাধনী সামগ্রী আছে এর সবই তৈরি হয় ঢাকা ও আশপাশ এলাকার নকল কারখানায়। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব কারখানায় বাজারে প্রচলিত দেশি-বিদেশি নামিদামি ব্রান্ডের প্রসাধনী, বোতল, কৌটা, লেভেল ও ট্রেডমার্ক হুবহু নকল তৈরি করছে। অসাধু এই চক্রটি বিএসটিআই অনুমোদিত একটি পণ্যের লাইসেন্সের আড়ালে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল পণ্য তৈরি করছে। ১০০ গ্রাম ওজনের নকল একটি বেবি সোপ তৈরি করতে খরচ হয় ৭/৮ টাকা অথচ আসল একটি জনসন বেবিসোপ এর দাম পরে ৭০ টাকা।এগুলো পাইকারি বিক্রি হয় ৩৫/৪০ টাকায়। ২৫০ এম এল কন্টেইনারের একটি ফগ বডিস্প্রের আমদানি মূল্য ১৯০ টাকা, পাইকারি বিক্রি হয় ২২০ থেকে ২২৫ টাকায, আর খুচরা বিক্রি হয় ২৫০ টাকার। একই পণ্য নকলকারীদের উৎপাদন খরচ হয় ৪৫ টাকার মতো পাইকারি বিক্রি করে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। এভাবেই প্রতিটি পণ্যে তে তিন চার গুণ বেশি লাভের আশায় নকল পণ্য বিক্রি করতে উৎসাহী হয় খুচরা দোকানিরা।
কেমিক্যাল আর পিয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় খাঁটি সরিষার তেল। ছানার পরিত্যক্ত পানির সঙ্গে আটা, ময়দা, এরারুট মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে খাটি দুধ, মরিচের গুড়ায় ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক রং ও ইটের গুড়া, কাউণ ও কাঠের গুড়া মিশিয়ে তৈরি করা হয় প্যাকেট মসলা, এভাবেই তৈরি হচ্ছে জুস, সেমাই, নুডুলস সহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী। মরা মুরগির রোস্ট আর শিয়াল-কুকুরকে খাশির গোস্ত হিসেবে খাওয়াতেও পিছপা হচ্ছে না রেস্টুরেন্ট গুলোতে। নোংরা পানিতে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম। রেডিয়েশনযুক্ত গুড়া দুধ আমদানি হচ্ছে অহরহ। ফরমালিনের ইনজেকশন দিয়ে মাছ বরফে চাপা দিয়ে রেখে বাজারজাত করা হচ্ছে হচ্ছে দিনের পর দিন।
মাদকের ভয়াবহতায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকগণ। অথচ নকলের কব্জা থেকে সেই মাদকও রেহাই পায়নি। পত্রিকার মাধ্যমেই জানা যায় সারা দেশে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা নকল হচ্ছে। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে এখন পর্যন্ত ঢাকাতে অন্তত নকল ইয়াবা তৈরীর ছয়টি কারখানা সন্ধান পাওয়া গেছে। ইয়াবা আকৃতির মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ব্যাথার ট্যাবলেট কিনে তাতে রং আর ইয়াবার ফ্লেভার মিশিয়ে বিক্রি করছে।
নকলের প্রবণতা আমাদের দেশের তৈরি পণ্যের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে। নকলের দাপটে আমাদের আসল পণ্য প্রায় নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিএস টি আই এর নির্লিপ্ততাই নকল সামগ্রীর দাপটের জন্য দায়ী। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগটি যুগ যুগ ধরে জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে দায় এড়িয়ে চলছে। ভুক্তভোগীরা মনে করেন বিএসটিআই এর অভিযান অব্যাহত থাকলে নকল পণ্যের দাপট কমতে বাধ্য।